বাংলাদেশে তামাকজাত পন্যের বিক্রয়কেন্দ্রের প্রকৃত সংখ্যা নিরুপনে ঢাকা শহরের সকল প্রকারের বিক্রয়কেন্দ্রের (মালামাল ও সেবা) উপর পরিচালিত জরিপের ফলাফল
এ কে এম মাকসুদ, নির্বাহী পরিচালক, গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি
পটভূমি: বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের মাত্রা বিপদজনক মাত্রায় রয়েছে এবং তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারনে বাংলাদেশের মানুষ ভয়াবহ আকারে স্বাস্থ্য ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। এই ভয়াবহ ক্ষতির কথা জেনেও বাংলাদেশের তামাক ব্যবসায়ী ও এক শ্রেনীর অসাধু নীতি কৌশল প্রনেতারা তামাক শিল্পখাতে বিশেষত তামাক বিপননে মানুষের জীবিকা ও কর্মসংস্থানের ক্ষতির কথা অতিমাত্রায় বিবেচনায় এনে তামাক নিয়ন্ত্রনকে বাধাগ্রস্থ করছে। তামাক নিয়ন্ত্রন করলে যে অনেক সংখ্যার মানুষের জীবিকা ও কর্মসংস্থানের ক্ষতি হবে এই দাবীটি মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত। এই বিষয়টি গবেষণা তথ্যের মাধ্যমে প্রমান করার জন্য বাংলাদেশের ৯টি সমাজকল্যানমূলক সংগঠন এক জরিপ পরিচালনা করে এবং জরিপের তথ্য সত্য প্রকাশ করেছে।
গবেষণা পদ্ধতি: বাংলাদেশে তামাকজাত পন্যের বিক্রয়কেন্দ্রের প্রকৃত সংখ্যা নিরুপনে ঢাকা শহরের সকল প্রকারের বিক্রয়কেন্দ্রের (মালামাল ও সেবা) এক নমুনা জরিপ চালানো হয়। প্রথম ধাপে ঢাকা শহরের মোট ১২৫টি ওয়ার্ড থেকে দৈব চয়ন পদ্ধতিতে ১৩টি ওয়ার্ড মোট এর ১০%) নির্বাচন করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচিত ১৩টি ওয়ার্ডের প্রতিটির ১টি করে ব্যস্ত মেইন রোড এর ৫০০ মিটার এবং ১টি গলি দৈব চয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচন করা হয়। তৃতীয় ধাপে ঐ নির্বাচিত ৫০০ মিটার দৈর্ঘের ১৩টি ব্যস্ত মেইন রোড এবং ৫০০ মিটার দৈর্ঘের ১৩টি গলির প্রতিটি দোকান (মালামাল ও সেবা) প্রকার উল্লেখ করে তালিকাভুক্ত করা হয়। সেই দোকানে তামাকজাত পন্য বিক্রয় হয় কিনা এবং সেই দোকানে শুধুমাত্রই তামাকজাত পন্য বিক্রয় হয় কিনা তার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর সাথে দোকানো জিপিএস লোকেশন ও ছবিও নেওয়া হয়। কোবোকালেক্ট নামক এক সফটওয়্যারের সহায়তায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ১৬-১৯ ফেব্রয়ারী ২০২৫ সময়কালে ৮টি সংস্থার প্রতিনিধিগন গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি এবং টিসিআরসির গবেষণা দলের তত্বাবধানে তথ্য সংগ্রহ করে।
জরিপের ফলাফল: জরিপ এলাকায় মোট ২৬১৬টি বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া যায়। জরিপ এলাকায় বিভিন্ন ধরণের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গিয়েছে যেমন: কাপড় ও রেডিমেড গার্মেন্টেসের দোকান (১০.৯%), চায়ের দোকান (৫.২%), ভ্রাম্যমান ভ্যানে ফলের দোকান (৪.৪%), ফুটপাতে চটপটি-ফুচকা-হালিম-ভাজা খাদ্যে-সিংগাড়া-পরির দোকান (৩.৮%), রেস্তোরা (৩.২%), ফুটপাতে তামাক বিক্রির দোকান (টং) (৩.০%), জুতার দোকান (৩.০%), ফলের দোকান (২.৯%), মুদি দোকান (২.৮%), ঔধধের দোকান (২.৬%), ফার্নিচারের দোকান (২.১%) চা-নাস্তার দাকান (২.০%), ফুটপাতে চা-বিস্কুটের দোকান (২.০%), ছোট দোকান (২.০%), ভ্রাম্যমান ভ্যানে তরকারীর দোকান (১.৯%), ভ্রাম্যমান পান-বিড়ি-সিগারেট ফেরিওয়ালা (১.৯%), শপিং মল (১.৯%), এটিএম বুথ (১.৮%), ব্যাংক (১.৫%), ইলেকট্রনিক্সের দোকান (১.৫%). ফাস্টফুড রেস্তোরা (১.৩%), মিষ্টির দোকান (১.১%), স্বাস্থসেবা কেন্দ্র (১.১%), টেইলরিং দোকান (১.১%), বিকাশ-ফ্লেক্সিলোডের দোকান (১.২%), বেকারী-কনফেকশনারী-কেকের দোকান (১.০%), ফুটপাতে মুচি-জুতাসেলাইয়ের দোকান (১.০%), ডিপার্টমেন্টাল স্টোর (১.০%) ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে আরও অন্যন্যা ধরণের দোকান (৩০.৮%)।
প্রতিটি দোকানই পরিদর্শন ও প্রশ্ন করে নিশ্চিত করা হয় যে সেখানে কোন তামাকজাত দ্রব্য (সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল ইত্যাদি) বিক্রয় করা হয় কিনা? গবেষণা তথ্যে দেখা যায় যে, শতকরা ১৮.৫ ভাগ বিক্রয়কেন্দ্র থেকে তামাজজাত দ্রব্য বিক্রিয় করা হচ্ছে। গবেষণা দল যখন পর্যবেক্ষণ ও জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয় যে বিক্রয়কেন্দ্রেটি কি শুধুমাত্রই তামাজজাত দ্রব্য বিক্রয় করে কিনা? গবেষনা তথ্য বিশ্লেষণ বলতে মোট বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শতকরা ২.৪ ভাগ শুধুমাত্রই তামাজজাত দ্রব্য বিক্রয় করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যূরো পরিচালিত ‘‘পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায় জরিপ প্রতিবেদন-২০২১”-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০০৯-২০১০ সময়কালে বাংলাদেশে স্থায়ী ও অস্থায়ী মোট ব্যবসায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহের সংখ্যা ছিল ২৬,৫০,১২৪ এবং সেখানে ৫২,৬৪,৯০০ মানুষ কর্মরত ছিল (২০২১ জরিপে শুধুমাত্র স্থায়ী ব্যবসায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বলা হয়েছে যা ছিল ২৫,৪০,৮৯৭)।
তাই বলা যায় আনুপাতিক হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশে ৪,৯০,২৭৩ টি প্রতিষ্ঠান তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সাথে জড়িত এবং ৯,৭৪,০০৬ জন মানুষ অন্যসব পন্যের সাথে তামাকজাত দ্রব্যও বিক্রয় করে। তবে একই হিসাবে সমগ্র বাংলাদেশে ৬৩,৬০৩ টি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্রই তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সাথে জড়িত এবং ১,২৬,৩৫৮ জন মানুষ শুধুমাত্রই এককভাবে তামাকজাত দ্রব্যও বিক্রয় করে।
গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি পরিচালিত জরিপ ২০২৫ এ দেখা যায় যে মোট বিক্রয়কেন্দ্রের মধ্যে শতকরা মাত্র ২.২ ভাগ বিক্রয়কেন্দ্র হলো ‘‘ভ্রাম্যমান সিগারেট/পান/বিড়ি/চা/রুটি/কলা/বিস্কুট বিক্রেতা”। সেই হিসেবে বাংলাদেশে আনুমানিক ৫৮,৩০৩ জন মানুষ সারা বাংলাদেশে ‘‘ভ্রাম্যমান সিগারেট/পান/বিড়ি/চা/রুটি/কলা/বিস্কুট বিক্রেতা”।
উপসংহার: হকার বা ভ্রাম্যমান বিক্রেতা বা ফেরিওয়ালাদেও মাধ্যমে তামাকজাত পন্য বিক্রয় করা নিষিদ্ধ করলে সর্বনিম্ন ৫৮,৩০৩ থেকে সর্ব্বোচ্চ ১,২৬,৩৫৮ মানুষের জীবিকার উপর প্রভাব পড়বে। তবে হকার বা ভ্রাম্যমান বিক্রেতা বা ফেরিওয়ালাদের তামাকের বিকল্প লাভজনক পন্য বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ ও দক্ষতা রয়েছে।